বর্ষায় ভরসায়
– রাণা চ্যাটার্জী
“আরে নহি নহি, ছতরি হমে নাহি চাহিয়ে, আপ সমালকে বৈঠিয়ে ম্যাডামজি”- না গো তাতে কি, কাল থেকে কি বৃষ্টিটাই না হচ্ছে বলোতো! “আমি আরাম করে বসবো আর তুমি ভিজবে তা কি হয় ?” মনে মনে এই ভাবনা থেকেই ভিজে ছাতাটা খুলে বয়স্ক রিক্সা জ্যেঠুর মাথার উপর ধরেছে তিস্তা।
এই প্রান্তিক অভাবী মানুষগুলো এমনই, শত কষ্ট সহ্য করে মেনে নিতে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ভাগ্যিস এনাকে পাওয়া গেল, নইলে আজ অফিস যাবার দফারফা! ততক্ষণে ঝড়ো দমকা হাওয়ায় খানা খন্দ পার করে এগিয়ে চলেছে রিকশা। তিস্তার হাতটা ব্যথা হবার উপক্রম এতক্ষণ এগিয়ে ধরে আছে ছাতাটা তবু এই সব কাজের মধ্যে মনে একটা আলাদা প্রশান্তি আসে। কাল সন্ধ্যায় ফেরার পথে সে যা ঝমঝম বৃষ্টি, একটা না আছে রিক্সা না টোটো। একদম জনশূন্য রাস্তায় থম থম করা লাইট পোস্টের সাক্ষী হয়ে ছলাৎ ছলাৎ করে জল পেরিয়ে বাড়ি ফিরেছে। আর এই যা বৃষ্টি আটকায় নাকি ছাতায়, তাই ফিরে থেকে নাক টেনে হেঁচে অস্থির মেয়ে।
এদিকে দু’দিন পরই কালীপুজো, অফিসে বেশ কিছু কাজ পেন্ডিং, সদ্য দুর্গাপুজোর এতগুলো ছুটির পর সবে অফিস খুলেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রেনকোট পড়ে সকালে বেরিয়ে আরেক কাণ্ড! ইস গলির মুখটা কি যাচ্ছেতাই গা ঘিনঘিনে অবস্থা হয়েছে। ড্রেনের জল বৃষ্টির জল উপছে মিলে মিশে যা তা! বৃষ্টিটা যদিবা সকালে একটু থামল আবার সুর চড়িয়েছে। আজ কপালে দুঃখ আছে বেশ বোঝাই যাচ্ছে আটটা বিয়াল্লিশের স্টেট বাসটা পেলে হয়, না আছে দাঁড়িয়ে কোনো রিকশা, টোটো! খানিক তফাতে ওপারে থাকা চায়ের দোকানের জটলা থেকে কেউ একজন কটাক্ষে চাপা আওয়াজ তুললো। চোখ তুলে তাকাতেই সব ঝেড়েমেরে চুপ, ভদ্র মানুষ হয়ে মাটির ভাঁড়ে গরম চা’য়ে ফুঁ।
সামনে যদি কিছু পায়, অগত্যা দু’ কদম এগুতেই চাল গদির বারান্দায় জড়োসড়ো আড়মোড়া ভাঙ্গা বিহারী রিক্সাওয়ালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে, হয়তো যাত্রী আসবে অপেক্ষায়। “ও জ্যেঠু যাবে নাকি?
“-বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা তিস্তার। যা বৃষ্টি হচ্ছে, কাউকে যাবে কিনা প্রশ্ন, অনুরোধ করতেও খারাপ লাগে তবু দেখি না হলে বাড়ি ফিরব এমন স্থির করার মাঝেই ঝেড়ে মেরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিলো রিক্সাওলা। “কি হলো তোমার শরীর ঠিক তো জ্যেঠু, তাহলে নাহয় ছেড়ে দাও, বসো।”-হালকা করে কানে এলো কি বললো যেন,”নাতনি বিটিয়াকা ভুখার হ্যায় পাঁচ দিন সে কাম নাহি কিয়া, খানাপিনা রেশন কা খরচা ভি উঠানা হ্যায়-নাহি তো ভারী বারিস মে কৌন নিকালতা হ্যায়!,আপ আইয়ে ম্যাম.. “
দাঁড়াও ভিজো না বলে তিস্তা ভিজে ছাতা বের করে মাথার উপর ধরল। এই মানুষগুলো আমাদের জন্য এত করে, একটু যদি সহমর্মী আমরা না হই তাহলে কিসের মনুষ্যত্ব! খুব কম যাত্রী নিয়ে স্টেট বাস ছাড়ার অপেক্ষায় আর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। একটু জোর করেই কুড়ি টাকার বদলে পঞ্চাশ টাকার নোটটা হাতে গুঁজে আসছি বলে দৌড়ে বাসটায় চাপলো তিস্তা। প্রৌঢ় রিকশাওলা তখনও হাঁ করে তাকিয়ে বাসের দিকে টাকাটা মাথায় ছুঁয়ে।